শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১০:৪১ অপরাহ্ন
মো: জিসান রহমান, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ
আজ ২৮ জুন, বিশ্ববিখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪০ সালের এই দিনে, চট্টগ্রামের হাথাজারি উপজেলায়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে। তিনি এখন শুধু বাংলাদেশের গর্ব নন, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
ড. ইউনূসের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ইউনূস জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানাতে উদ্বুদ্ধ করেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে কিছুদিন সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেন, পরে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ তাঁর চিন্তাজগতে বড় পরিবর্তন আনে। তিনি উপলব্ধি করেন, ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনে বিপ্লব আনতে পারে। এই উপলব্ধির পর ১৯৭৬ সালে জোবরা গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে পরীক্ষামূলক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেন। এ থেকেই জন্ম নেয় একটি বৈশ্বিক মডেল—গ্রামীণ ব্যাংক, যা ১৯৮৩ সালে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ ঋণগ্রহীতা নারী, যা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
এই অনন্য কাজের জন্য তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে যৌথভাবে লাভ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। একইসাথে তিনি সেই বিরল সাতজন ব্যক্তির একজন হিসেবে স্বীকৃত, যিনি নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল (২০১০) অর্জন করেছেন।
ড. ইউনূস বিশ্বের নানা প্রান্তে অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৮৪ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কারসহ ১৪৫টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার তার ঝুলিতে রয়েছে। বিশ্বের ৭১টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করেছে।
লেখক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাঁর ‘Banker to the Poor’, ‘Creating a World Without Poverty’, ‘A World of Three Zeros’—এই তিনটি বই বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর দর্শন ছিল—“চ্যারিটি নয়, সুযোগ দিন”, “চাকরির জন্য নয়, চাকরি তৈরির জন্য কাজ করুন”, এবং “স্বপ্ন দেখুন, বাস্তবায়ন করুন”।
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে পৌঁছায়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এই সংকটকালীন মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। ৮ আগস্ট ২০২৪ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এর আগেও তিনি ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য ছিলেন। ২০২২ সালে গ্লোবাল ই-স্পোর্টস ফেডারেশনের সঙ্গে অংশীদার হন এবং ২০২৪ সালে আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ২০২৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
নোবেল পুরস্কার লাভের পর তিনি পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনূস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি’, একটি চক্ষু হাসপাতাল এবং দরিদ্রদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধুমাত্র একজন নোবেলজয়ী নন, তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের এক আন্তর্জাতিক প্রতীক। ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি যেভাবে লাখো মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর জন্মদিনে আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব এক কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছে এক মহান মানবতাবাদী অর্থনীতিবিদকে।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩