শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন
আবু তাহের, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিঃ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভুক্ত ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে জালিয়াতির চেষ্টা ফাঁস হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৎপরতায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের মধ্যে রয়েছেন ত্রিশালের ওবায়েত হাসান আফিক, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের পনির উদ্দিন খান পাভেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী সালমান ফারদিন সাজিদ সিয়াম।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট), বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চূড়ান্ত ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়। ওইদিন ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হন গুচ্ছ রোল ২০১৬৯৭-এর পরীক্ষার্থী ওবায়েত হাসান আফিক। তবে তিনি স্বাক্ষর দিতে ব্যর্থ হন, প্রবেশপত্রের ছবির সঙ্গে তার চেহারার মিল ছিল না, এমনকি সাধারণ প্রশ্নের জবাবও দিতে পারেননি। এতে উপস্থিত শিক্ষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে অভিভাবক পরিচয়ে উপস্থিত হন পনির উদ্দিন খান পাভেল। তাদের কথাবার্তায় অসঙ্গতি ধরা পড়লে, শিক্ষকেরা আফিকের মোবাইল ফোন পরীক্ষা করেন। সেখানে পাভেলের সঙ্গে ভর্তি সংক্রান্ত কথোপকথন ও নির্দেশনা সংবলিত হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাওয়া যায়। পাভেলের আইফোন চেক করে শিক্ষকরা পিএসসি, বিসিএস, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার প্রায় ৪০০-৫০০টি এডমিট কার্ড ও পরীক্ষার্থীদের ছবি উদ্ধার করেন।
একপর্যায়ে একটি ফোন কল আসার পর পাভেলের ফোনটি লক হয়ে যায়, যা দীর্ঘ সময়ের জিজ্ঞাসাবাদেও খোলা সম্ভব হয়নি। পরে আফিক স্বীকার করেন, তিনি প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
তদন্তের একপর্যায়ে পাভেলের ফোনে ‘সিয়াম’ নামে একজন কল করে জিজ্ঞেস করেন, “ভর্তির কী অবস্থা ভাই?” বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটাবেস ঘেঁটে জানা যায়, কলকারী হলেন সালমান ফারদিন সাজিদ সিয়াম, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
সিয়ামকে এনে জিজ্ঞাসাবাদে সিয়াম স্বীকার করেন, তিনি লোক প্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী কৌশিক কুমার চন্দের হয়ে গুচ্ছ রোল ২০৪৩৯৩ নম্বর ব্যবহার করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। বিনিময়ে পাভেল তাকে এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এই সময় সিয়ামের ফোনে আরও একটি কল আসে শান্ত ভূঁইয়া নামে এক শিক্ষার্থীর, যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র এবং সিয়ামের বন্ধু। জানা যায়, শান্তর মাধ্যমেই সিয়ামের সঙ্গে পাভেলের পরিচয় হয়।
তদন্তে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে সিয়ামের ফোনে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া পুনিয়া দে মৃদুর ওএমআর শিটের ছবিও পাওয়া গেছে।
পাভেল জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তিনি ‘বাবু’ নামে এক ব্যক্তির নির্দেশে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন এবং বাবুই পুরো চক্রটি তদারকি করেন। কৌশিকের ভর্তি নিশ্চিত করতে বাবু নিজেও সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন।
তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি, ওবায়েত হাসানের প্রক্সি হয়ে কে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আফিক ও কৌশিক উভয়েরই প্রক্সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে।
ঘটনার পর গুচ্ছভুক্ত ভর্তি পরীক্ষার নিরাপত্তা, নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষা কেন্দ্রের স্বচ্ছতা এবং জামালপুর কেন্দ্রের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান জানান, চক্রের মাধ্যমে আরও একজন শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে ভর্তি হয়ে গেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে, যার যাচাই-বাছাই চলছে। আটক তিনজনকে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তে পাঁচ-ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে, যা আগামী রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।
ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনসুর আহাম্মদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে এবং শুক্রবার আটককৃতদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “ঘটনাটি জামালপুর কেন্দ্রে ঘটলেও, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সজাগ দৃষ্টির কারণেই জালিয়াতি চক্রের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে এসেছে। আমরা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে পুরো চক্রের সন্ধানে কাজ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সতর্ক রয়েছে।”
শিক্ষার্থীরা জালিয়াতি চক্রের পুরো নেটওয়ার্ক উন্মোচন এবং সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩