রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন
মোঃ জিসান রহমান, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষক স্বশরীরে শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে স্বৈরাচার পতনের জন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। শিক্ষকরা জুগিয়েছেন সাহস, দিয়েছেন অনুপ্রেরণা, ঢাল হিসাবে দাঁড়িয়েছেন সামনে। তাদেরই একজন অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা এ্যাওয়ার্ড নিয়ে সদ্য যোগদান করা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের শিক্ষক ড. জিয়াউর রহমান।
কাঁধে নীল ব্যাগ, পড়নে সাদা শার্ট, ড. জিয়াউর রহমান যিনি ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মাভাবিপ্রবির জননতো আব্দুল মান্নান হলের সামনে তৎকালীন হল প্রশসানের একজন শিক্ষক দ্বারা অপমানিত ও শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হন। ছাত্রদের ঘেরাও এর মাঝে দাঁড়ানো তৎকালীন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. ইদ্রিস আলী, অধ্যাপক ড. আশরাফ হোসাইন তালুকদার, ড. নুরুল ইসলাম ও হযরত আলী।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান বলেন, “আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুবই অল্প সময়ের। কিন্তু বিষয়টি খুবই অপমানজনক ও কষ্টের। যেই ক্যাম্পাসকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। যার কল্যাণের কথা ভেবে সব ছেড়ে দেশে এসেছি। সেখানে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর দায়ে সহকর্মীর হাতে অপমানিত হতে হবে এটা ভাবতে অবাক লাগে। সেই দিনটির কথা ভাবতে আজও কষ্ট হয়। আমার ক্যাম্পাসে সম্মান পাওয়ার আশা যদি আমার খায়েশ হয়, তবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
খুব বেশি দিন হয়নি। ৪ আগস্ট, ২০২৪ইং বেলা সাড়ে বারটা। আমি দুপুরের খাবারের জন্য ক্যাম্পাস থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম। অধিকাংশ আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা ঐদিন শহরে চলে গেছে শুনেছি। এক-দেড়শো শিক্ষার্থীর একটা মিছিল মান্নান হলের দিকে যাচ্ছে। আগের দিন (৩ আগস্ট, ২০২৪) প্রধান ফটক ভেঙ্গে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেও, শিক্ষার্থীরা কোন এক অজানা কারণে হলে না ঢুকেই বের হয়ে যায়। ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে যেসকল শিক্ষকগণ বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের সন্তান তুল্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিয়েছন নিশ্চয়ই তাদের ত্যাগের কথা সবারই মনে থাকবে।
আমি আর পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছোট ভাই ও সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাক ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, মিছিলের পেছনে হাঁটতে থাকি। ছাত্ররা মান্নান হলে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে, তা দেখে আমরা দুজন ১২ তলার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এসময় হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের বেশ কয়েকজন সহকর্মী ঘটনাস্থলে আসেন। আমি ও আব্দুর রাজ্জাক তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের উত্তপ্ত কথোপকথন শুনছি। মাত্র কদিন আগে যে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ মনে করে, রাতের আঁধারে হল থেকে বের করে দিয়েছে, তারা আবার গেট ভেঙ্গে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদেরকে নতুন কোন বিপদে ফেলে কি না? চিন্তা করতে থাকি। এদিকে গেটের বাইরে পুলিশের মারমুখী অবস্থান নিজ চোখে দেখে এসেছি একটু আগে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, মোবাইল থেকে ভিডিও করার মনস্থির করি। উপস্থিত সহকর্মীদের অনুমতি ও ভদ্রতাসূচক মুচকি হেসে ভিডিও করার কথা বলি। ভিডিও শুরু করার পর পেছন থেকে অতর্কিত ভাবে একজন শিক্ষক আমাকে সজোরে ধাক্কা দেন । তার হাত দিয়ে আমার হাতে আঘাত করেন। পরে ধমকের স্বরে বলতে থাকেন কিসের ভিডিও? এই কিসের ভিডিও? এতে আমার হাত থেকে মোবাইটি পড়ে যায়। আমি লজ্জা পেয়ে দূরে সরে দাঁড়াই।
উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষকরা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেন। আমি ভীত ও লজ্জিত হয়ে আমার সাথে আসা শিক্ষক ছোট ভাই আব্দুর রাজ্জাককে খুঁজতে থাকি। শিক্ষার্থীদের সামনে একজন শিক্ষকের এহেন আচরন দেখে আমি বিমর্ষ হয়ে ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াই।
শিক্ষার্থীদের মিছিল শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলে, আমি আগত শিক্ষকদের পেছনে হাঁটতে থাকি। পরবর্তীতে ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের শিক্ষকদের হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে জানাই। আমার মোবাইলে ধারণ করা একটি আংশিক ভিডিও শেয়ার করি।
৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে, আমি বিষয়টি জ্যেষ্ঠ দুই-তিনজন সহকর্মীকে বলি। তাঁরা তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। ঐ দিনের ঘটনায় (৪ আগস্ট ২০২৪ বেলা ১২:৩০ টা থেকে ১:১৫টা পর্যন্ত) উপস্থিত দু-তিনজন শুভাকাঙ্খী সহকর্মী আমাকে জানান, ৪ আগস্ট ঘটনাস্থল থেকে ফিরে আমাকে লাঞ্চিতকারী শিক্ষক ও তাঁর সহযোগীরা ভিসি স্যারকে আমার বিরুদ্ধে জিডি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে, আরো একজন প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক জিডি করার ব্যাপারে ভিসির সাথে তাঁদের কথোপকথনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাঁরা আমাকে থানায় খোঁজ নিতে বলেন। এটাও বলেন ভবিষ্যত চাকুরি-জীবনে এ ধরনের জিডি নাকি মামলার চেয়েও ভয়ংকর। আমি এখনো খোঁজ নিতে পারিনি আমার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করা হয়েছে কিনা। তবে খোঁজ নিতেও চাই না।
আমি জানিনা ঐদিন আমার কী অপরাধ ছিল? আমি শুধু আমাদের সন্তান তুল্য শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে, দুপুরের খাবার না খেয়ে ছাত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এটা আমার অপরাধ? যিনি আমাকে লাঞ্চিত করেছেন এবং যারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন, সে সব বিবেকবর্জিত শিক্ষকদের সম্মানের কথা চিন্তা করে অফিসিয়ালি তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি, কোন পদক্ষেপ নেইনি।
বরং তাদের অনেকেই সালাম দিলে উল্টো আমার সালামের উত্তরও দেন না। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরণের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরাই আবার প্রশাসনে উল্টো প্রভাব বিস্তার করার নানা ফন্দি আঁটছেন। সেদিনের সেই অসহায়ত্বের কথা ভেবে প্রায়ই মন খারাপ হয়। লাঞ্চনার চেয়েও সহকর্মীদের নির্লিপ্ত ভূমিকা মেনে নেওয়া বোধ হয় একটু বেশীই কঠিন।
এ রকম ঘটনার পুনরাবৃতি কখনই কামনা করি না। তবে, ভালো লাগে দুঃসময়ে আমাদের অসহায় সন্তানদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি।”
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩