শনিবার, ০৭ Jun ২০২৫, ০৯:১৫ অপরাহ্ন
আমির ফয়সালঃ
ঈদুল আজহা মানেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এক ধর্মীয় উৎসব। মুসলিমদের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদ বিশ্বজুড়ে নানা রূপে পালিত হয়। কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়, এটি আত্মত্যাগ, সহমর্মিতা ও সামাজিক সংহতির এক অনন্য শিক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদুল আযহার উদযাপন পদ্ধতি আলাদা হলেও মূল লক্ষ্য এক। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের কারণে কোথাও উট, কোথাও গরু বা ছাগল কুরবানি হয়; কোথাও আবার অনলাইন কুরবানি হয়ে উঠেছে সময়ের চাহিদা।
এই সংগ্রহে আমরা ঘুরে দেখবো বিশ্বের নানা দেশে ঈদুল আযহার বৈচিত্র্যময় রীতি ও রূপরেখা।
সৌদি আরবঃ ধর্মীয় পবিত্রতার সঙ্গে আধুনিক ব্যবস্থাপনা
হজের কেন্দ্রবিন্দু সৌদি আরবে কুরবানির আয়োজন সবচেয়ে বৃহৎ। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মরণে মিনার নির্দিষ্ট এলাকায় হজ পালনকারীরা সরকার অনুমোদিত ‘Adahi Project’ এর মাধ্যমে আধুনিক স্লটার হাউজে লক্ষাধিক পশু জবাই করে থাকেন। তারপর হিমায়িত করে বিশ্বের দরিদ্র মুসলিম অঞ্চলে বিতরণ করা হয় কুরবানির মাংস। স্বাস্থ্যবিধি, হালাল প্রক্রিয়া ও পরিবেশ সুরক্ষার দিক বিবেচনায় সৌদি আরব একটি আন্তর্জাতিক মডেল।
ইন্দোনেশিয়াঃ ভাগ করে নেওয়ার উৎসব
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের দিনকে বলা হয় ‘হারি রায়া ঈদুল ফিতরি’। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘Qurban Berbagi’ সংস্কৃতি—যেখানে মানুষ যৌথভাবে পশু কিনে কোরবানি দেয়। গরু বা ছাগলের ৭ জনের যৌথ কুরবানি অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্থানীয় মসজিদ ও এনজিওগুলো স্বচ্ছভাবে কোরবানি সংগ্রহ, জবাই ও বিতরণ করে। ২০২৩ সালে শুধু জাকার্তায় ১২ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। অনলাইন কোরবানি এখানেও ব্যাপক জনপ্রিয়, যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আদেশ দিয়ে পশু কোরবানি করানো যায়। ঈদের এই বিশেষ দিনটিতে নারীরা ‘কেবায়া কুরঙ্গ’ এবং পুরুেষরা ‘বাজু কোকো’ নামের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে।
তুরস্কঃ ঐক্যের ঈদ
তুরস্কে কোরবানির পশু কেনা, পরিচর্যা করা, নাম রাখা—সবই পারিবারিক উৎসবের মতো। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মাংস ভাগাভাগি করাকে এখানে ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনের প্রতীক বলা হয়। তুর্কি রেড ক্রিসেন্ট (Kızılay) ২০২৪ সালে ৩৬টি দেশে কুরবানির মাংস বিতরণ করে।
নাইজেরিয়াঃ ধর্মীয় সম্প্রীতির আয়না
আফ্রিকার এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ঈদুল আযহা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, সামাজিক মিলনমেলার একটি উপলক্ষ। নাইজেরিয়ায় ঈদ মানেই মুসলিম-খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের একত্রে আনন্দ ভাগাভাগি। এসময় কোরবানির হাটগুলো হয়ে ওঠে মিলনমেলা। ঈদের আগের সপ্তাহে গরুর দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও পশু জবাইয়ের পর পারস্পরিক সৌহার্দ্যের চিত্র লক্ষ্য করা যায়।
মরক্কো ও মিসরঃ উটের কুরবানি ও খাদ্যসংস্কৃতি
উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে উট কোরবানির ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে। পাশাপাশি তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার—‘Tagine’, ‘Mansaf’ ইত্যাদি। মরক্কোতে ঈদগাহকে বলা হয় মুসাল্লা আর এর ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে কাব ঘাজাল, মাহাঞ্চা, ঘ্রিবা অন্যতম। এখানকার মানুষ কোরবানির পূর্বে পশুকে গোসল করিয়ে, রঙ লাগিয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলে। মিসরীয়রা ঈদ উপলক্ষে ফাত্তার নামের একটি বিশেষ খাবার– মিষ্টান্ন তৈরি করে। অসহায় মানুষের মধ্যে ফিতরা বিতরণে মিসরীয়রা বেশ জোর দেয়। এখানে কুরবানি শুধু ধর্মীয় নয়, আনন্দ ও পারিবারিক বন্ধনের এক স্মারক।
ইউরোপ ও আমেরিকাঃ নিয়মের কড়াকড়ি, বিকল্প খোঁজ
অমুসলিম দেশগুলোতে আইনি বিধিনিষেধ থাকায় পশু কোরবানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্লটার হাউজে জবাই করা বাধ্যতামূলক। ফলে অনেক প্রবাসী মুসলিম অনলাইনে নিজ দেশে কোরবানি দিয়ে থাকেন।
ইসলামিক রিলিফ, Penny Appeal, HCI প্রভৃতি সংগঠন ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসীদের হয়ে ৫০টিরও বেশি দেশে কোরবানি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে বহুদূরে।
উপমহাদেশঃ কোরবানির হাটের আনন্দ ও ভোগান্তি
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে কোরবানির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো কোরবানির হাট। পশু কেনা, দামের দরকষাকষি, ট্রাকে করে পশু আনা, নাম রাখা—সব মিলিয়ে এটি ঈদের এক আবেগঘন অংশ।
তবে অতিরিক্ত দাম, দক্ষ কসাইয়ের সংকট ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা অনেক সময় জনদুর্ভোগের কারণ হয়।
চীনঃ নানা সীমাবদ্ধতার আয়োজন
চীনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা জিনজিয়ান ও নিংজিয়া প্রদেশে ঈদ উপলক্ষে তিন দিন ছুটি থাকে। মুসলিমদের জন্য এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঈদ উদ্যাপনের আয়োজন থাকে। ভেড়া জবাই করা হয় তাদের জন্য। জিয়াং নামের একধরনের বিশেষ খাবার তৈরি করে তারা। ঈদের দিনের সম্মানার্থে রাস্তায় টোল আদায় করা হয় না।
অনলাইন কোরবানির রমরমা
বিশ্বজুড়ে অনলাইন কোরবানি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্মঃ
বাংলাদেশঃ As- Sunnah Foundation,QurbaniBazaar, AmarQurbani
পাকিস্তানঃ MeatOne, Qurbani Online
ইন্দোনেশিয়াঃ GoQurban, ShopeeQurban
প্রবাসীদের জন্যঃ Islamic Relief, Muslim Hands
এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে কোরবানি স্বচ্ছ, সহজ ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে।
নতুন ট্রেন্ডঃ কুরবানি ট্যুরিজম
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা আমেরিকায় প্রবাসী মুসলিমরা ঈদের সময় নিজ দেশে ফিরে কোরবানি দেন। এতে তারা নিজের হাতে পশু জবাই করতে পারেন, পরিবারসহ ঈদ পালন করতে পারেন এবং দরিদ্রদের মাঝে নিজ হাতে মাংস বিতরণ করতে পারেন।
এই ট্রেন্ডটিকে বলা হচ্ছে ‘Qurbani Tourism’।
দেশ/অঞ্চল → প্রচলিত কোরবানির পশু
১. বাংলাদেশ, ভারত → গরু, ছাগল
২. সৌদি আরব, কুয়েত → উট, ভেড়া
৩. তুরস্ক, ইরান → ভেড়া, ছাগল
৪. নাইজেরিয়া, সুদান → গরু, ভেড়া
৫. মরক্কো, মিসর → উট, গরু
৬. ইউরোপ-আমেরিকা → ভেড়া (আইনি কারণে ছোট পশু)
উপসংহার
ঈদুল আযহার উৎসবে বৈচিত্র্য থাকলেও বার্তা একটাই—আত্মত্যাগ ও মানবতার শিক্ষা। পশু কোরবানির মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়, তা কোনো ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মীয় বিধান ও স্থানীয় প্রেক্ষাপট অনুযায়ী উদযাপিত এই ঈদ হোক সংহতি, শান্তি ও মানবতার প্রতীক।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১৫-১২৫২৪৩