শনিবার, ২৬ Jul ২০২৫, ০৩:২১ পূর্বাহ্ন
সীমান্ত নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে থাইল্যান্ড ও ক্যাম্বোডিয়ার মধ্যে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ক্যাম্বোডিয়ার একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালিয়েছে থাইল্যান্ড। উভয় দেশই এ হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই উত্তেজনায় ইতোমধ্যে এক শিশুসহ অন্তত ৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
থাই সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এফ-১৬ বিমান দিয়ে কম্বোডিয়ার একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে গুলি ছোড়া হয়েছে এবং তা ধ্বংস করা হয়েছে। দুই দেশই বৃহস্পতিবার ভোরে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে।
থাই সেনাবাহিনীর উপ-মুখপাত্র রিচা সুকসুয়ানোন বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান শক্তি ব্যবহার করেছি।’ একই সঙ্গে থাইল্যান্ড তাদের ক্যাম্বোডিয়া সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে ক্যাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, থাই যুদ্ধবিমান দুটি বোমা ফেলে একটি রাস্তায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এক বিবৃতিতে দেশটি জানায়, ‘থাইল্যান্ড কর্তৃক ক্যাম্বোডিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার ওপর এই বেপরোয়া ও নির্মম সামরিক আগ্রাসনের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।’
থাইল্যান্ড বুধবার রাতে ক্যাম্বোডিয়া থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে এবং ব্যাঙ্ককে ক্যাম্বোডিয়ান দূতকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেওয়া দিয়েছে। এর আগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরও একজন থাই সেনা ভূমিমাইন বিস্ফোরণে পা হারান। থাইল্যান্ড দাবি করেছে, ভূমিমাইনটি সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্বোডিয়া পুঁতে রেখেছে।
থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্যাম্বোডিয়ান সেনারা বৃহস্পতিবার সকালে থাই সামরিক ঘাঁটির ওপর ‘ভারী কামান হামলা’ চালিয়েছে এবং একটি হাসপাতালসহ বেসামরিক এলাকাও টার্গেট করেছে, যাতে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এক বিবৃতিতে থাই সরকার জানায়, ‘যদি ক্যাম্বোডিয়া আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে থাকে, তাহলে থাইল্যান্ড আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ জোরদার করতে প্রস্তুত।’
থাইল্যান্ডের সুরিন সীমান্ত প্রদেশে শিশু ও বৃদ্ধসহ বাসিন্দারা বালুর বস্তা ও টায়ার দিয়ে তৈরি করা কংক্রিটের বাংকারে আশ্রয় নেন।
ক্যাম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাইল্যান্ডের এই বিমান হামলাকে ‘উস্কানিমূলক ও অযৌক্তিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং থাই বাহিনীকে সীমান্ত থেকে প্রত্যাহার করে নিতে ও ভবিষ্যতে এমন উত্তেজনাকর আচরণ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানিয়েছে।
১৮৭০-এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন অনির্ধারিত অংশ নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। এর ফলে অনেকবার সংঘর্ষ হয়েছে এবং বহু প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে ২০১১ সালের এক সপ্তাহব্যাপী কামান লড়াই অন্যতম।
গত মে মাসে এক ক্যাম্বোডিয়ান সেনার মৃত্যুর মাধ্যমে এ উত্তেজনার নতুন সূচনা হয়। সেই ঘটনা পরে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সংকটে রূপ নেয় এবং এখন তা সশস্ত্র সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ সংঘর্ষ শুরু হয় বৃহস্পতিবার ভোরে, থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত তা মোয়ান থম মন্দির সংলগ্ন একটি বিরোধপূর্ণ এলাকায়।
থাই সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সীমান্তের তিনটি প্রদেশে এখন পর্যন্ত নয়জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে সুরিনে আট বছর বয়সী এক শিশু রয়েছে।
সুরিনের কাফচিয়াং জেলার প্রধান সুত্তিরত চরোয়েনথানাসাক রয়টার্সকে বলেন, ‘আর্টিলারি শেল সাধারণ মানুষের ঘরে পড়েছে।’ তিনি জানান, ওই সীমান্তবর্তী এলাকার ৮৬টি গ্রাম থেকে ৪০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
থাইল্যান্ডের সিসাকেট প্রদেশে একটি পেট্রোল স্টেশনে আগুন ধরে যাওয়ার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় ঘন কালো ধোঁয়া উড়ছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভাতে ছুটে আসেন।
সেখানে ছয়জন নিহত ও ১০ জন আহত হন বলে সেনাবাহিনী জানায়। আরেকজন উবন রাতচাথানি সীমান্ত প্রদেশে মারা যান।
থাই সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘থাই সেনাবাহিনী ক্যাম্বোডিয়ার মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। আমরা আমাদের জনগণ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত।’
তারা আরও জানায়, ক্যাম্বোডিয়া একটি নজরদারি ড্রোন মোতায়েনের পর মোয়ান থম মন্দির এলাকায় ভারী অস্ত্রসহ সৈন্য পাঠায় থাইল্যান্ড। সেখানে ক্যাম্বোডিয়ান সেনারা গুলি ছোড়ে এবং এতে দুই থাই সেনা আহত হন। ক্যাম্বোডিয়া রকেট লঞ্চারসহ নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলেও দাবি করা হয়।
তবে ক্যাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, থাই সেনারা বিনা উসকানিতে সীমান্তে প্রবেশ করেছিল এবং ক্যাম্বোডিয়ান বাহিনী আত্মরক্ষার্থে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই বলেন, ‘পরিস্থিতি সংবেদনশীল। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করব।’
সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ক্যাম্বোডিয়ার প্রভাবশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে ফোনে উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করেন। এই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে গেলে থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং পায়েতংতার্নকে আদালত সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে।
হুন সেন ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন, ক্যাম্বোডিয়ার দুটি প্রদেশ থাই গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছে।
থাইল্যান্ড এই সপ্তাহে অভিযোগ করেছে, ক্যাম্বোডিয়া সাম্প্রতিককালে সীমান্ত এলাকায় নতুন করে ভূমিমাইন পুঁতেছে, যাতে তিনজন সেনা আহত হন। তবে ফনম পেন এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, আহত সেনারা পূর্ব নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পুরনো যুদ্ধকালে পুঁতে রাখা মাইনেই পা দিয়েছেন।
ক্যাম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পুঁতে রাখা মাইনের সংখ্যা কয়েক মিলিয়নে পৌঁছেছে বলে বিভিন্ন মাইন অপসারণকারী সংস্থা জানিয়েছে।
তবে থাইল্যান্ডের দাবি, সীমান্ত এলাকায় সম্প্রতি নতুন করে ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছে কম্বোডিয়া।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩