বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৩ অপরাহ্ন
প্রণয় জ্যোতি দেওয়ান, বিলাইছড়ি (রাঙ্গামটি) প্রতিনিধি:
রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সাফল্যের শিখর—বিলাইছড়ির তরুণ সুমন চাকমার জীবন সংগ্রাম প্রমাণ করে, অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই চিরন্তন সত্যের পথে অন্তরায় হতে পারে না।
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার পরিহোলা মোন গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সুমন চাকমা-র। পিতা রসময় চাকমা এবং মাতা শেফালিকা চাকমার ৪ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে সুমন সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির এবং পড়াশোনায় অত্যন্ত মনোযোগী।
২০০২ সালে দীঘলছড়ি সরকারি আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা। ২০০৮ সালে বিলাইছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে কাপ্তাইয়ের বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ। ডিপ্লোমা শেষ করেই সুমনের মনে একটাই স্বপ্ন—জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা! কিন্তু একটি মধ্যবিত্ত পরিবার এবং দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠার কারণে অর্থের অভাব ছিল তাঁর স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই অভাব বা দুর্গবম পথ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জীবনের এই কঠিন সময়েই শুরু হয় তাঁর আসল লড়াই।
মেধা ও ভাগ্যক্রমে, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তিনি চট্টগ্রামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি (ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড) -তে চাকরির সুযোগ পান। জার্মানিতে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা এতে আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। দিনের বেলায় চাকরির চাপ সামলেছেন, আর রাতে বা ছুটির দিনে মন দিয়েছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে। বিলাসিতা ত্যাগ করে নিজের সকল শখ এবং হাত খরচের টাকা জমিয়েছিলেন শুধু স্বপ্নের জন্য। চাকরির পাশাপাশি ২০১৭ সালে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল খুবই পরিষ্কার “চাকরি করে পরিবারকে সাহায্য করা, আর স্বপ্নের জার্মানি যাওয়ার জন্য সকল প্রস্তুতি নেওয়া।” তাঁর এই কঠিন পরিশ্রম এবং ত্যাগই তাঁকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।
অবশেষে, সুমনের দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম সার্থক হয়। ২০২০ সালে তিনি পাড়ি জমান তাঁর স্বপ্নের দেশ জার্মানিতে। সেখানেও চাকরির পাশাপাশি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেন। ২০২২ সালে তিনি জার্মানির কেম্পটেন ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সস -এ মাস্টার্স ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হন। ২০২৫ সালে তিনি সফলভাবে কোর্স সম্পন্ন করেন।
তাঁর এই আন্তর্জাতিক সাফল্য আজ শুধু তাঁর একার নয়, এটি তাঁর শিক্ষক-শিক্ষিকা, পরিবারের সদস্য এবং বিশেষ করে তাঁর পিতা-মাতার ত্যাগেরও জয়। এত বড় সাফল্যের পরেও সুমন চাকমা নিজের শিকড় ভোলেননি। তাঁর হৃদয়ে এখনো জন্মভূমির জন্য গভীর টান। তিনি শুধু নিজের জন্য বাঁচতে চান না। তিনি তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে ভবিষ্যতে তাঁর এলাকার গরিব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থী এবং অসহায় বয়স্ক মানুষদের জন্য কাজ করতে চান।
তিনি চান, অর্থের অভাবে বা সুযোগের অভাবে যেন আর কোনো মেধাবী সম্ভাবনা থেমে না যায়। সুমন চাকমার সফলতার এই গল্প আমাদের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি আমাদের শেখায়—যদি বুক ভরা সাহস আর মনে অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকে, তবে কোনো বাধাই মানুষকে থামাতে পারে না; মনের জোরই আসল শক্তি।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩