মোঃ হাসান হাওলাদার, কমলনগর (লক্ষীপুর) প্রতিনিধি:
ওয়ান-ইলেভেনের (১/১১) সেই ভয়াবহ সময়ে, যখন ১০২ জন সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তখন মিডিয়া বিএনপি'র পক্ষে কথা বলার মতো একজনকেও খুঁজে পাচ্ছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে এ বি এম আশরাফ উদ্দিন নিজান সিংহের মতো গর্জন করে মিডিয়ার সামনে আসেন। তিনি ঘোষণা দেন, "১০২ জন তো দূরের কথা, দুজনও মান্নান মিয়ার সাথে থাকবে না। আমরা সবাই খালেদা জিয়াএবং তারেক রহমানের নেতৃত্বে এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকব।"
তার এই এক বক্তব্যে সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী বেগম জিয়ার সাথেও তিনি নানা কৌশলে দেখা করেছেন। প্রচারবিমুখ এবং সেই সময়ে তুলনামূলকভাবে অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই আশরাফ উদ্দিন নিজানই দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
একইভাবে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যখন বিএনপি'র নেতাদের দলচ্যুত করার চেষ্টা করছিল, তখনো তিনি ঢাল হয়ে দাঁড়ান। শাহজাহান ওমর ও জেনারেল ইব্রাহিমের মতো নেতারা যখন প্রলোভনে পা দিয়ে সংসদ সদস্য হন, তখন আশরাফ উদ্দিন নিজানই অন্য নেতাদের উদ্বুদ্ধ করে হাই কমান্ডের সাথে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন। যাদের অনেককেই আজ বিএনপি পুরস্কৃত করে মনোনয়ন দিয়েছে।
২০২৪ সালের 'জুলাই বিপ্লব'-এ ও (July Revolution) তার ভূমিকা ছিল। হাই কমান্ডের নির্দেশে যখন যার সাথে যোগাযোগ করার কথা, তিনি ঝুঁকি নিয়ে নেপথ্যে থেকে সেই অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন।
সংসদ সদস্য হিসেবে সততা ও উন্নয়ন, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হন। তৎকালীন মন্ত্রী তাকে ১০ কোটি টাকা মূল্যের তিনটি ট্রলার ঘুষ হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।
সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে পাঁচবার বিদেশ সফরের সুযোগ এলেও তিনি সরকারি টাকায় একবারও বিদেশে যাননি। এমনকি তিনি কখনো ফ্ল্যাগ, প্রটোকল বা দেহরক্ষী ব্যবহার করেননি।
লক্ষ্মীপুর-৪: এক অভিভাবকের নাম, লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে তিনি বিএনপির দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় ও দু’বারের (২০০১ ও ২০০৮) সাবেক সংসদ সদস্য। এই অঞ্চলে তিনি উন্নয়নের এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। রামগতি উপজেলার উত্তরাঞ্চলকে পৃথক করে কমলনগর উপজেলা গঠন, নদীভাঙন প্রতিরোধ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা—এসবই তাঁর নেতৃত্বের সাক্ষ্য বহন করে।
দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনের সময় যখন হাজার হাজার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী হামলা-মামলার শিকার হচ্ছিলেন, নিজান সাহেব তাদের পাশে থেকে আইনি সহায়তা, আর্থিক সহায়তা এবং নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসন করেছেন। রামগতি ও কমলনগরের সাধারণ মানুষের কাছে তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, একজন অভিভাবক।
রামগতির সমস্ত হাট বাজার, টেম্পু স্ট্যান্ড, নদীঘাট এর ইজারার টাকা তিনি নিজে পরিশোধ করেছেন। সেখানে কোন নেতাকর্মী এক পয়সার চাঁদাবাজি করার সুযোগ রাখেননি।
আওয়ামী সরকারের পতনের পরও তিনি নিরলসভাবে মাঠে থেকে জনগণকে সংগঠিত করছেন এবং ঘরে ঘরে ধানের শীষ ও রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচি পৌঁছে দিচ্ছেন।
ব্যাক্তিগত স্মৃতি ও হাই কমান্ডের আস্থা, তিনি হাই কমান্ডের কতটা বিশ্বস্ত ছিলেন তা একটি ঘটনাতেই স্পষ্ট। বহুল আলোচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মধ্যকার সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি তার বাসাতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জীবনের একটি স্মৃতি উল্লেখ না করলেই নয়। আশরাফ উদ্দিন নিজানের মূল বাড়ি চট্টগ্রাম। একসময় আ স ম আবদুর রবের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রব সাহেব চট্টগ্রামে গেলে নিজানের বাসায় উঠতেন। তখন নিজানের পাঁচ বছরের ছেলে অনিন্দ্যর সাথে রব সাহেবের এক অসম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ৯৬ সালে আ স ম রব যখন মন্ত্রী হলেন, টিভিতে তা দেখে অনিন্দ্য চিৎকার করে বলে, "বাবা, আমার বন্ধু মন্ত্রী হয়েছে! আমি মন্ত্রীর সাথে কথা বলব।আমি মন্ত্রীর সাথে কথা বলব, আমি মন্ত্রীর সাথে কথা বলব"
আশরাফ উদ্দিন নিজান তৎক্ষণাৎ আ স ম রবকে ফোন করে বলেন, "রব ভাই অভিনন্দন অনিন্দ্য অনিন্দ্য একটু আপনার সাথে কথা বলবে।" কিন্তু রব সাহেব ব্যস্ততার অজুহাতে বলেন, "নিজান, আমি ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব।" সেই 'পরে' আর আসেনি, অনিন্দ্যর সাথে তার আর কথা বলা হয়নি।
আশরাফ উদ্দিন নিজান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। ছাত্র রাজনীতির পরের তিনি রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। আমারই প্রচেষ্টা, অনুপ্রেরণা এবং বারবার তাগিদে আশরাফ উদ্দিন নিজান বেগম জিয়ার সাথে দেখা করে বিএনপিতে যোগদান করেন।আমি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আ স ম আবদুর রবকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সরকার গঠনের পর ল্যাপটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন নৌপরিবহন মন্ত্রী হলেন। আমি এবং নিজান সাহেব সচিবালয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি আকবর ভাইকে বললেন, "আকবর ভাই, আমার ছেলের সাথে একটু কথা বলবেন?" আকবর হোসেন সানন্দে রাজি হলেন। আশরাফ উদ্দিন নিজান ফোন করে অনিন্দ্যকে বললেন, "বাবা, মন্ত্রীর সাথে কথা বল।"
সেদিন আমি আশরাফ উদ্দিন নিজানের আনন্দাশ্রু দেখেছিলাম।
চূড়ান্ত ঠিকানা, আমি একটা কথা নিশ্চিত জানি, তিনি মনে-প্রাণে, ধ্যানে-জ্ঞানে জিয়া পরিবারকে ধারণ করেন। বেগম জিয়াকে তিনি 'মা' বলে সম্বোধন করেন এবং তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে আছেন তারেক রহমান। নিজান ভাই তার নির্বাচনী এলাকায় যে নিষ্ঠা, মানবিকতা আর ত্যাগের সঙ্গে কাজ করেন— সেরকম উদাহরণ বাংলাদেশে আর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তিনি হৃদয়ে-মননে-চেতনায় ধারণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ।
বেগম খালেদা জিয়াকে তিনি “মা” বলে সম্বোধন করেন।
তার আত্মার গভীরে কেবল এক নাম— তারেক রহমান।
কখনো মান-অভিমান থেকে তিনি অনেক কথা বললেও, আমি নিশ্চিত, জিয়া পরিবারই তার সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত ঠিকানা।