সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন
মোঃ জিসান রহমান, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ
২০২৪ সালের ৩ আগস্ট, মেঘলা আকাশ ও থেমে থেমে বৃষ্টির মধ্যে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) প্রধান ফটকের সামনে শতাধিক শিক্ষার্থী জমায়েত হয়। ফটকে তালা থাকলেও শিক্ষার্থীদের চোখে ছিল আগুন, গলায় ধ্বনিত হচ্ছিলো “স্বৈরাচারী সরকারের পতন চাই, গণতন্ত্র চাই, হল খুলে দাও!”।
প্রশাসনের দীর্ঘ প্রতারণা, ছাত্রলীগের হুমকি ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। দুপুরের দিকে একযোগে সবাই স্লোগান দেয় “ইনকিলাব জিন্দাবাদ!” আর ফটকের তালা ভেঙে দেয় তারা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মাভাবিপ্রবি বাংলাদেশে প্রথম ‘স্বৈরাচারবিরোধী হলমুক্ত বিদ্রোহী ক্যাম্পাস’ হিসেবে ইতিহাস রচনা করে। এটা শুধু তালা ভাঙার ঘটনা নয়, বরং নিপীড়নের শৃঙ্খল ছিন্ন করার এক প্রতীকী আন্দোলন।
ইসরাত জাহান এ্যাথি, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী, জানান ৩ আগস্টের দিন টাঙ্গাইলে ছিল ভয়াবহ অবস্থা। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকজন রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা না পেয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হন তিনি। ছোট মনিরের লোকদের বাধায় তিনি আটকেও যান। পরে অনেক ঝামেলা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে এসে গেটের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রশাসনের অস্বীকৃতি ও নানা তালবাহানার কারণে অবশেষে তালা ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন এবং ছাত্রলীগের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন।
তরফদার রোহান, গণিত বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী, বর্ণনা করেন ১৭ জুলাই হল বন্ধ হয়ে পড়ার পর শহরে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাইপাস ব্লক করেন। ৩ আগস্ট বৃষ্টির মধ্যে প্রথম গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করার। বিভিন্ন শিক্ষকও আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। বিশেষভাবে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাহসী অবস্থান শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেয়। স্লোগান আর শিক্ষকদের বক্তব্যে আন্দোলন আরও গতি পায়। অবশেষে গেট ভেঙে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন।
আক্তারুজ্জামান সাজু, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী, বলেন ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১ আগস্ট ক্যাম্পাস দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ৩ আগস্ট শিক্ষার্থীরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে গেটে সমবেত হয়। শিক্ষকদের সমর্থনও ছিল। প্রশাসন স্বারকলিপি গ্রহণে বাধা দেয়, ফলে তারা ২০ মিনিট আল্টিমেটাম দিয়ে গেট ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এটি দেশের প্রথম ‘হলমুক্ত ক্যাম্পাস’ আন্দোলনের সূচনা।
মরিয়ম আক্তার মীম, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী, জানান ২০১৮ সালের কোটা পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তনের বিরুদ্ধে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হয়। মাভাবিপ্রবিতেও শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। ছাত্রলীগের হুমকি ও নির্যাতনের মধ্যেও তারা সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ৩ আগস্ট গেটের তালা ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া সেই মুহূর্ত কখনো ভুলবেন না বলে জানান তিনি।
মো নাইমুর রহমান দূর্জয়, রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী, বলেন ১৭ জুলাই প্রশাসনের হল ত্যাগের নির্দেশনা পেয়ে আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু স্বৈরাচারী প্রশাসন ও ছাত্রলীগের জোরপূর্বক হুমকি-ধামকি ও নির্যাতনের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা সহ্য করেনি। পুলিশ রাতভর শিক্ষার্থীদের হয়রানি করলেও তারা হাল ছাড়েনি। ৩ আগস্ট গেট ভেঙে ক্যাম্পাস দখল করে প্রক্টরের কাছে হল খোলার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, মাভাবিপ্রবির এই আন্দোলন শুধু একটা রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল না; এটি ছিল এক নতুন স্বাধীনতা, এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায় যেখানে শিক্ষার্থীরা নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। আজ এই ক্যাম্পাস বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতন্ত্রের এক দৃষ্টান্ত, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করেছে।
”যদি আবার কখনো স্বৈরাচার মাথা তুলে দাঁড়ায়, আমরা রাজপথে নামব,” এই শপথ নিয়ে মাভাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলেছে একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক স্মৃতি।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩