মোতাহের উদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)স্টেশন এটি শুধু একটি রেলওয়ে স্টেশন নয়, শিক্ষার্থীদের কাছে এটি আবেগ, অনুপ্রেরণা ও বন্ধুত্বের মিলনমেলা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে জমে উঠে আড্ডা, রাজনৈতিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই স্টেশনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যময় ক্যাম্পাস সংস্কৃতি,যা নতুন অভিজ্ঞতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগও করে দিচ্ছে।
স্টেশন চত্বরে প্রতিদিনই নানা বয়সী শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখা যায়।কেউ ক্লান্ত শরীরে বসে থাকেন,কেউবা ছুটে যান আড্ডার দলে,আবার অনেকে ব্যস্ত থাকেন গান,ফটোগ্রাফি কিংবা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে।তবে এই রঙিন পরিবেশের মাঝে কিছু পরিশ্রমী শিক্ষার্থী তাদের নিজস্ব উদ্যোগকে এগিয়ে নিচ্ছেন যত্ন করে,স্বপ্ন দেখছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। ক্যাম্পাসে পড়ালেখার পাশাপাশি আয়-রোজগারের চিন্তা থেকে তারা খুলছেন ছোট ছোট ব্যবসা।কেউ দিয়েছেন চায়ের দোকান, কেউ পাহাড়ি খাবারের স্টল,কেউ হ্যান্ডমেট সামগ্রীর দোকান।আবার কেউ তরুণদের আলোচনার নতুন ধারা সৃষ্টি করতে চালু করেছেন 'রঙ চায়ে পলিটিক্স '।
এই শিক্ষর্থীদের গল্পগুলো শুধু ব্যবসা নয়,গল্পগুলো আত্মনির্ভরতা,সংগ্রাম আর বিকাশের।
লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২৩-২০২৪ সেশনের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন বলেন"আর্থিক চাপ সামলানো তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল এবং ক্যাম্পাসে টিউশন পাওয়া অনিশ্চিত ও সময়সাপেক্ষ।এসব ভাবনা থেকেই তিনি চায়ের দোকান খুলে স্বাবলম্বী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জাহিদ বলেন"চবি ক্যাম্পাসে টিউশন পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি স্বাধীনতার জায়গাও থাকে না। নির্দিষ্ট সময় মেনে চলতে হয়। তাই নিজে কিছু করার চিন্তা থেকেই ব্যবসাটা শুরু করি।"
তিনি জানান,একজন বড় ভাইয়ের পরামর্শ এবং শিক্ষক ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় শুরু করতে পেরেছি। নিজের উপার্জন পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করতে চাই-এটাই তার লক্ষ্য।
টিউশনের উপর নির্ভরতা কমাতে জিহাদের 'জিহাদ টি স্টল'। জিহাদ টি স্টল এখন অনেক শিক্ষার্থীর পছন্দের জায়গা যেখানে চায়ের পাশাপাশি পাওয়া যায় স্টেশনের উষ্ণতা ও আন্তরিকতা।
রং চা এর পলিটিক্স: আলাপ-আলোচনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছেন রবিউল।
ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী রবিউল হাসান ভিন্নধর্মী একটি উদ্যোগ নিয়েছেন" রং চায়ের পলিটিক্স।"
রবিউলের মতে ব্যবসা মানে পণ্য বিক্রি নয়; এর সঙ্গে জড়িত থাকে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, ভাবনা আদান-প্রদান এবং সামাজিক বাস্তবতাকে বোঝার সুযোগ।
তিনি বলেন, "স্বাধীনতার জায়গা থেকেই ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছি। রং মানে আর্ট, চা মানে চা, রাজনীতি মানে জীবনের সবকিছু। তাই দোকানের নাম রেখেছি রং চায়ের পলিটিক্স। এখানে মানুষ আসে, মতামত জানায়, আলোচনা হয়।
তিনি আরো বলেন "আমি চাই দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রং চায় পলিটিক্স গড়ে তুলতে যেখানে তরুণরা নিজেদের ভাবনা শেয়ার করবে। রাজনীতি শুধু নেতাদের জন্য নয় প্রতিদিনের জীবনের অংশ তার দোকানটি হয়ে উঠেছে তরুণদের বুদ্ধি ভিত্তিক আড্ডার নতুন কেন্দ্র।
পাহাড়ি খাবারের স্বাদ ছড়িয়ে দিচ্ছেন য়ইমেনু মারমা। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২৩-২৪ সেখানে শিক্ষার্থী য়ইমেনু মারমা পরিচালনা করেন পাহাড়ি খাবারের দোকান 'লারং মুন্ডি ছোইং"। এখানে পাওয়া যায় পাহাড়ি স্বাদের খাবার যা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করে।
য়ইমেনু বলেন, পরিবারের উপর চাপ কমানো ও ক্যাম্পাস একটি ইউনিক ইনকাম সোর্স তৈরি করা এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি ধরে রাখার লক্ষ্যেই আমি এ ব্যবসা শুরু করেছি।
তিনি জানান স্টেশনে জায়গা বন্টন নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিলেও তিনি আশাবাদী যে প্রশাসন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করবেন।
তিনি বলেন যখন শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে পাহাড়ি খাবার তখন করতে আসে তখন খুবই আনন্দিত হয়।
য়ইমেনুর কাছে ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবারের উপর থেকে আর্থিক চাপ কমানো এবং একই সাথে পাহাড়ে সংস্কৃতি চর্চা করা ।
রঙিন খেলা হাতে বানানো স্বপ্ন গুনছেন নির্জনা।
চারুকলা বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী তানজিনা আফরোজ নির্জনা ২০২০ সাল থেকে রঙিন খেয়াল নামে হ্যান্ডমেড জুয়েলারি দোকান পরিচালনা করেন। নিজের শিল্পকর্ম, ক্রাফ্ট ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন।
তিনি বলেন, অনলাইনে মানসম্মত হ্যান্ডমেড জুয়েলারি সহজলভ্য না থাকায় নিজের উদ্যেগে ফেসবুক পেইজ খুলে পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রি শুরু করি। পরে দোকানও দেই আর মানুষ আমার কাজ দেখে প্রশংসা করলে অনুপ্রাণিত হই। নির্জনার স্বপ্ন নিজেকে একদিন বড় উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং দেশজ হস্তশিল্পকে নতুন পরিচিতি দেওয়া।
শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগ ক্যাম্পাসে স্বাবলম্বী হওয়ার নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। আর্থিক চাপে থাকা অনেকের জন্য এসব ক্ষুদ্র ব্যবসা হয়ে উঠছে সাহস ও সম্ভাবনার নতুন জানালা।
দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বেকারত্ব, চাপ, আর্থিক সংকট তরুণদের দুশ্চিন্তার কারণ সেখানে চবি স্টেশন প্রমাণ করে দিয়েছে, যদি ইচ্ছা থাকে, একটি ছোট দোকানও হতে পারে জীবনের বড় পরিবর্তন।
প্রশাসনের কার্যকর সহযোগিতা পেলে এসব তরুণ উদ্যোক্তা আরও বিকশিত হতে পারবেন বলে তারা মনে করেন।