বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৫৮ পূর্বাহ্ন
মোঃ আবু বকর সুজন, চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধিঃ
ছেলের সুন্নতে খাতনার উপহার হিসেবে পাওয়া একটি স্বর্ণের চেইন বিক্রি করে সে টাকায় কেনেন একটি বাছুর। সে বাছুর থেকে তার খামারে এখন ২৮ টি গরুর দুগ্ধ খামারে পরিণত হয়েছে।
শুন্য থেকে যাত্রা শুরু হওয়া হাজেরা বেগম কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের মুন্সিরহাট ইউনিয়নের বিশ্ববাগ গ্রামের বাসিন্দা। হাজেরা বেগম আজ শুধু একজন সফল নারী উদ্যোক্তাই নন তিনি গ্রামের শত শত নারীর অনুপ্রেরণা।
হাজেরা বেগম বলেন, প্রায় ৮ বছর আমার বিয়ে হয়। এরপর শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু করার সাহস হয়নি। কিন্তু মনে প্রবল ইচ্ছা ছিল কিছু একটা করব। কিন্তু আর্থিকভাবে শুরু করব সেটার কোন উপায় ছিলনা। আমার ছোট ছেলে বাড়ির পাশে অন্যদের গরুর বাছুর নিয়ে খেলত এতে প্রায়ই বকাঝকা শুনতে হতো। সেখান থেকেই নিজের গরু পালনের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। এরপর ছেলের সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠানে আমার ছেলেকে তার নানীএকচি স্বর্ণের চেইন উপহার দেন। ওই স্বর্ণের চেইন বিক্রি করে সে টাকা দিয়ে চট্টগ্রামের মিটাছড়া হাট থেকে ২৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাছুর কিনি। এরপর লালন-পালন শুরু করি। কোরবানির ঈদে সেটি ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এরপর এ টাকা দিয়ে বড় ছেলে ও ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী থেকে পাঁচটি ষাঁড় বাছুর কিনে বাড়িতে আনি। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সন্তানদের নিয়েই শুরু করি ষাড় পালন। এ পাঁচটি ষাড় থেকে আরও গরু বাড়তে থাকে । প্রতিদিন গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতে শুরু করি। এখন আমার খামারে ছোট বড় ২৮টি গরু রয়েছে। আমার খামারের নাম হাজেরা ডেইরি ফার্ম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গরুর লালন-পালন, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাও নিজ হাতে করছেন হাজেরা বেগম। প্রতিবেশী ও দর্শনার্থীদের কোথা থেকে বাছুর সংগ্রহ করবেন, কীভাবে খাবার দেবেন, রোগ হলে কী চিকিৎসা, কিভাবে গরুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে দানাদার খাবার তৈরী, কাঁচা ঘাস ও মাঝে মাঝে ভুট্টার সাইলেজ ব্যবহার করা শেখাচ্ছেন।
হাজেরা বেগম আরও বলেন, খামার থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ লিটার দুধ বিক্রি হয়। দুধের ক্রিম থেকে প্রতিদিন তৈরি হয় ৫-৬ কেজি খাঁটি ঘি। সব মিলিয়ে তার মাসিক আয় প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। বছরে আয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
হাজেরা বেগমের সাফল্য দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও স্বীকৃতি পাচ্ছে। তার এই অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড এজি এক্সপোতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। এই খবরে এলাকায় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন কীভাবে সম্ভব হাজেরা বেগমের যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা।
বর্তমানে প্রতিদিন সকালে একজন কর্মচারীর মাধ্যমে দুধ দোহণ ও বাজারজাত করা হয়। বিকেলে পরিবারের সন্তানদের নিয়ে নিজেই দুধ দোহণ ও বিক্রির কাজ করেন হাজেরা বেগম। গত বছর ২০২৪ সালে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে স্বামী একরামুল হক খামারের কাজে সহযোগিতা করছেন।
অভাব-অনটনের দিন পেরিয়ে আজ হাজেরা বেগমের সংসারে স্বচ্ছলতা। বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। ছোট ছেলে ও মেয়ে স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যথাক্রমে সপ্তম ও নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে এবং পড়ালেখায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে।
আর্থিক অভাব ও সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে গড়ে ওঠা হাজেরা বেগমের এই সাফল্যগাথা শুধু তার পরিবার নয়—চৌদ্দগ্রামসহ পুরো উপজেলায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল সাগর বলেন – চৌদ্দগ্রামের নারী উদ্যোক্তা হাজেরা বেগম তিনি ৮-১০ জন যাবত থেকে একটি খামার পরিচালনা করে আসছেন। উনি একটি ক্রিম সেপারেটর মেশিনের মাধ্যমে তার উৎপাদিত যে দুধ এবং ক্রিম সেটা সেটা আলাদাভাবে তৈরি করে এবং বাজারজাত করছেন । আমরা খুবই আনন্দিত হাজার বেগম ইউএসএ-তে ৫৯তম আন্তর্জাতিক ওয়ার্ড এগ্রিকালচার এক্সপ্রো হবে সেখানে তিনি ইনভিটেশন পেয়েছেন। আমি অবশ্যই আশা করব আমাদের বাংলাদেশ তথা চৌদ্গ্রামের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার যে একটা প্রতিফলন সকল নারী উদ্যোক্তা এবং নারী ডেইরি খামারি সফলতার সহিত কাজ করছেন সেটাকে তিনি বিশ্বের দরবারে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন
স্থানীয় মুন্সিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কমলেশ মন্ডল বলেন আমাদের বিদ্যালয় একজন মেধাবী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমরান। শ্রেণী কক্ষে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। পাশাপাশি তার পিতা মাতাকে পারিবারিক যুদ্ধ খামারে সহযোগিতা করছেন। আমি এ খবরটি জেনে খুবই আনন্দিত হলাম আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রটির পরিবার আমেরিকা একটি গ্রামে ইনবেটেশন পেয়েছেন। বর্তমান সময় যেখানে বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা গ্রামে মোবাইল ফোন মাধ্যমে আসক্ত থাকে সেগুলো থেকে সে আলাদা থেকে পড়াশুনাতে যেরকম মেধার স্বাক্ষর রেখেছে সেরকমভাবে তার পিতা মাতাকে সহযোগিতা করে পারিবার আর্থিক উন্নতিতে লাভবান হচ্ছে।
2025 © জনপদ সংবাদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রয়োজনে যোগাযোগঃ ০১৭১২-০৬৮৯৫৩